বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ‘দেউলিয়া’ ন্যারেটিভের ময়নাতদন্ত

সম্পাদকীয়
ডোরিন চৌধুরি
০৪:০৫:১০পিএম, ২২ মে, ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলংকায় চলছে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। একই সময়ে, গত একমাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৪ বিলিয়ন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ যখন ভোগান্তিতে, তখন কমে যাচ্ছে টাকার মান ও। সবকিছু মিলিয়ে অনেকেই মনে করছেন, শ্রীলংকার পথে হাটছে বাংলাদেশ।

জার্মান মিডিয়া ডিডব্লিউ এর এক প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিটের অর্থ। তাদের মতে, আমদানী ব্যয়, রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স আসার পরেও প্রতিবছর বাংলাদেশের কারেন্ট একাউন্টে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, জনমনে আশংকা, বাংলাদেশ শ্রীলংকার পথেই হাটছে। আবার বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে কেউ কেউ দেখছেন ‘সিঁদুরে মেঘ হিসেবে’।

সব মিলিয়ে গত কয়েকমাসের পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যা বিবেচনায় প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি বাংলাদেশ দেউলিয়া হবার পথে? শ্রীলংকার মতই কি পরিণতি হতে চলেছে বাংলাদেশের? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এবং সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের দিকে।

শ্রীলংকার সমস্যার মূল কারণ: শ্রীলংকার সমস্যার মূলকারণ, ঋণ সংকট, তলানিতে ঠেকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং সরকারেরে ভূল কৃষিনীতি। করোনা মহামারীর পর থেকেই শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার দুটি প্রধান উৎস- পর্যটন খাত ও রেমিটেন্স স্থবির হয়ে পড়ে।

এদিকে, ব্যয়বহুল মেগাপ্রজেক্ট এবং কঠিন শর্তের ঋণের কিস্তি ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে, তলানিতে গিয়ে ঠেকে রিজার্ভ। এরই মধ্যে মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত যুক্ত হয় ব্যর্থ কৃষি নীতি এবং নির্বাচনী অঙ্গীকার কর কমানো। সবমিলিয়ে, শ্রীলংকা ব্যর্থ হয় ঋণের কিস্তি পরিশোধে এবং পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।

গোটা দেশে সংকট দেখা দেয়। মৌলিক চাহিদা, সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি এবং কর্তৃত্ববাদের অবসানের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ। অপার সৌন্দর্যের লীলাভুমি, দ্বীপরাষ্ট্রটি এইমুহুর্তে পার করছে  তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসময়, ইতোমধ্যে পতন হয়েছে প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের। নতুন প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সহসাই অবস্থায় পরিবর্তন হচ্ছে না, সেটা এখন সবাই জানে।

শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ এর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির ভিন্নতা: শ্রীলংকার সংকটের মোটামোটি কোন প্রধান কারণই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রকট আকারে নেই। একমাসে ৪ বিলিয়ন ডলার কমে গেলেও, বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ আছে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার, যা শ্রীলংকায় মাত্র ৫০ মিলিয়নের নিচে নীচে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের এই রিজার্ভ আগামী ৬ মাসের আমদানী খরচ মেটাতে যথেষ্ট।

আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ নীতি অনুসারে যা একেবারেই আদর্শ। সংরক্ষণ নীতি মতে, একটি দেশের রিজার্ভ যদি আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের আমদানী ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট হয় তবে তা নিরাপদ অবস্থা। সুতরাং, একমাসে ৪ বিলিয়ন ডলার কমে গেলেও, বাংলাদেশে এখনো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে।

এছাড়া, ঋণের কিস্তি পরিশোধেও বাংলাদেশ এখনো ভালো অবস্থানে আছে। বর্তমানে প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করে চলেছে। শ্রীলংকার তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ সহনীয় অবস্থাতেই রয়েছে। শ্রীলংকার ঋণের পরিমাণ তার জিডিপির প্রায় ১০৪% পৌছেছে, যা মাথাপিছু প্রায় ১৬৫০ ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ঋণ জিডিপির মাত্র ২২%, এবং মাথাপিছু মাত্র ২৯২ ডলার।

অর্থনীতি অনুসারে, জিডিপির ৬০% এর নিচে ঋণ থাকলে তা সহনীয় বা সাসটেইনেবল বলে ধরা হয়। এছাড়া, পাবলিক ডেট বা সরকারি ঋণেও বাংলাদেশ বেশ স্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারী ঋণ জিডিপির মাত্র ৪০% যেখানে শ্রীলংকায় তা ১০১% পৌছে গিয়েছে। ডেট সাস্টেইনেবিলিটি বা ঋণের সহনমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় ২০% সরকারী ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে, অন্যদিকে শ্রীলংকা সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।

এছাড়াও, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের ডেট সাস্টেইনেবিলিটি রিপোর্টও বলছে বাংলাদেশের জন্য ঋণ সংকটে পড়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে মহামারীকালেই এবং রিপোর্ট তৈরিতে অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল।

এ তো গেলো ঋণ পরিশোধের ব্যাপার, শ্রীলংকার সংকটের একটি উপাদান। বাকি উপাদান গুলো যেমন বৈদেশিক মুদ্রার উৎস এবং সরকারী নীতির দিক থেকেও বাংলাদেশ এবং শ্রীলংকার বিরাট তফাৎ রয়েছে।

মহামারীতে শ্রীলংকার রেমিটেন্স ও পর্যটনখাত স্থবির হয়ে পড়ে। করোনাকালে শ্রীলংকা মাত্র সাড়ে ৮বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স অর্জন করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মূল বৈদেশিক মুদ্রার উৎস রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক শিল্প করোনার মধ্যেও ব্যপক সাফল্য অর্জন করেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে রেমিটেন্স অর্জনে ৭ম হয়। এসময় বাংলাদেশ ২১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পায় যা পূর্বের বছরের তুলনায় ২.২% প্রবৃদ্ধির ফল। করোনার তৃতীয় বর্ষেও রেমিটেন্স এর আগমন ক্রমেই বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ রেকর্ড ২.০৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আয় করে। অন্যদিকে, পোশাক খাতও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হতাশ করেনি। এমনকি, চলতি অর্থবছরেও, মাত্র ১০মাসেই ইতিমধ্যে রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জন করেছে খাতটি।

এছাড়াও, শ্রীলংকার মত কর কমানো, কৃষিনীতির ব্যর্থতা, বা সংকট বাংলাদেশের নেই। অন্যদিকে, আমদানি-রপ্তানী ও রেমিটেন্সের মধ্যে থাকা ঘাটতির আশংকা উঠেছে সেটিও বিশাল নয়। মূলত, বাংলাদেশের কারেন্ট একাউন্ট বা চলতি হিসাবে ১০ বিলিয়ন ডলার ঘাটতির কথা হচ্ছে, যা রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশকে মেটাবে হবে। কিন্তু, চলতি হিসাবের বাহিরে ক্যাপিটাল একাউন্ট বা বিদেশী বিনিয়োগের হিসাব আমলে নেয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশে প্রতিবছর আসা বিদেশী বিনিয়োগের কথা মাথায় রাখলে ঘাটতি আরো অনেক কম হবে, অন্তত ১০ বিলিয়ন পৌছাবে না। তাই, অর্থনীতির  গতিপ্রকৃতির বিবেচনায় এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র বিশ্লেষণে একথা বলাই যায়, বাংলাদেশ সহসাই দেউলিয়া হওয়ার মত অবস্থানে নেই। তবে, অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব এবং বিশ্বব্যপী সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়ছে, যা অবহেলা করার একবারেই সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কী?- বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লাগামহীন আমদানী ব্যয় এবং চলমান মূদ্রাস্ফীতি। সাপ্লাই চেইন ব্যহত হওয়ায় এবং ইউক্রেন ক্রাইসিস সহ নানান বৈশ্বিক সমস্যার প্রভাবে বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি চলছে। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির ট্রাকের লাইন।

এরমধ্যে, খানিকটা আশার বাণী হচ্ছে পাম অয়েলের উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ফলে ভোজ্যতেলের দাম খানিকটা কমতে পারে সামনে।  অন্যদিকে, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয়। কেবল চলতি অর্থবছরেই আমদানি ব্যয় ৪৪% বৃদ্ধি পেয়ে ৬১ বিলিয়নে পৌছেছে। যা বছরেই ৮০ বিলিয়নে পৌছাতে পারে।

আমদানি ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলির মধ্যে বিশ্ববাজারে অত্যধিক দামবৃদ্ধি এবং করোনার কারণে দুবছর বহুপণ্যের আমদানি কম থাকা অন্যতম। তবে, এখনি আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ না নিলে চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তেই থাকবে, যা কয়েকবছর পর বাংলাদেশের জন্য হুমকির স্বরুপ।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সহসাই দেউলিয়া হবার তেমন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো শক্ত অবস্থানেই রয়েছে। তবে চিন্তার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং মূদ্রাস্ফীতি। সময় থাকতেই এই দুটি বিষয়ে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।

একই সাথে, মহামারী ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সরকারের উচিত হবে উন্নয়ন প্রকল্প এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গুলিকে পুনঃমূল্যায়ন করা এবং আগামী কয়েক বছরের ঋণ পরিশোধের পরিকলপনা প্রস্তুত করা। আশা করা যায়, সবকিছু ঠিকঠাক চললে এবং সরকার যথাযথ ভূমিকা পালন করলে বৈশ্বিক সংকটের যে প্রভাব বাংলাদেশের উপর, তা সময়সাপেক্ষ হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে।

ডোরিন চৌধুরি, নেদারল্যান্ডের গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে “দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বায়ন এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব” বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণারত একজন গবেষক।