আসন্ন বাজেট ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা

সম্পাদকীয়
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
০৫:১১:৪১পিএম, ২৫ মে, ২০২২
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ফাইল ছবি

আমাদের দেশের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে পেশাদারিত্বের ছাপ থাকে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে, অর্থ বিভাগ ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উভয় জায়গাতেই যারা বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এছাড়া বাজেট চূড়ান্তকরণের আগে এতে অর্থমন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হয়। প্রতি বছরই বাজেটের আকার বিগত বছরের চেয়ে বড় হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে, দেশের জিডিপির অব্যাহত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যয় বৃদ্ধির চাহিদার বিপরীতে অর্থ জোগান দেয়া। সামষ্টিক ব্যয়ের অর্থ জোগানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করতে হয়। ব্যয় ও সম্পদ সংগ্রহের পার্থক্য বা ডেফিসিট বা ঘাটতি যথাসম্ভব সীমিত রাখার মধ্যেই রয়েছে বাজেট প্রণয়নের কৃতিত্ব। তাই এবারের বাজেটে নিজস্ব সম্পদ ও ব্যয়ের মধ্যে অগ্রাধিকার বিবেচনায় সমন্বয় সাধন জরুরি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের মোট পরিমাণ ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা হতে পারে, চলতি বাজেটের তুলনায় যা ৭৪ হাজার ৩ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটের আকার হবে জিডিপির ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এবারের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। মোট ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে বরাদ্দের কোনো পূর্বাভাস না পেলেও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি বরাদ্দ থাকবে।

এবারের বাজেট এমন এক সময় প্রণীত ও ঘোষিত হতে যাচ্ছে, যখন সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ইউরোপের দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি আরো অনেক বেশি। মূল্যস্ফীতি ছাড়াও কভিড-১৯-এর প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উৎপাদন হ্রাস ও সরবরাহ চেইন বিপর্যস্ত হওয়ায় ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, ২০০৭-০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর এমন সংকট আর দেখা যায়নি। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও গম উৎপাদনে রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে বিধায় এসব দ্রব্যের সরবরাহ চেইন দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও অতিমুনাফাখোরির ফলে মূল্যবৃদ্ধি। বিবিএসের হিসাবমতে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। তবে বেসরকারি থিংক ট্যাংকগুলোর জরিপ অনুযায়ী দেশের মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ অতিক্রম করেছে বলে তাদের ধারণা। ২০০৭-০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত বাংলাদেশে না পড়ার কারণ ছিল আমাদের উৎপাদন, সরবরাহ চেইন, কর্মসংস্থান ও ভোগ চাহিদা সচল ছিল। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ভোগে ঘাটতি না থাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কারণে করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপর্যয় হয়নি, বরং ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

তবে এ বছরের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ ও অলাভজনক প্রকল্পে ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টানপড়াসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতার ফলে শ্রীলংকার অর্থনীতির যে বিপর্যয় হয়েছে, বাংলাদেশেরও সে অবস্থা হতে পারে বলে অনেকে সতর্ক করছে, যদিও আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি শ্রীলংকার চেয়ে অনেক মজবুত ও উন্নত। অবশ্য অর্থবছরের গত ১০ মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১ শতাংশ। কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সপ্রবাহেও মন্দা রয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে নেমে ৪১ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, কয়েক মাস ধরে রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। ডলারের বিপুল চাহিদার কারণে টাকার মূল্যমান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বেসরকারি মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খবরে জানা যাচ্ছে, দেশের ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। এটি কোনো ভালো খবর নয়। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে যাতে ব্যাংকিং সেক্টরে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমানোর জন্য সরকার এরই মধ্যে কতিপয় ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারি ব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণে লাগাম টানা হয়েছে। বিলাসদ্রব্য ও কসমেটিক, টয়লেট্রিজ আমদানিও নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। তবে আশু প্রয়োজন হবে এমন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানিতে কোনো বাধা থাকা ঠিক হবে না। বর্তমান সময়ে আরো একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য। তা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আমদানি-রফতানিতে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং না হয়। আমাদের দেশে মানি লন্ডারিং একটা কঠিন রোগ। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি, ব্যবসায়ী বা দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী সুযোগ পেলেই অর্থ পাচার করতে পারে। এবারের বাজেটে কঠিন শাস্তি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে নতুন কোনো ঋণ খেলাপি না হয়। বরং খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। আসন্ন বাজেটেও ঋণ খেলাপিদের জন্য কঠিন বার্তা থাকতে পারে।

এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। করোনাকালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অনেকে কর্ম হারিয়েছেন। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাদের কর্মের সংস্থান করা যেতে পারে। পিকেএসএফ ও এ ধরনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। সেজন্য ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থাগুলোর বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাজেটে প্রণোদনা ও বরাদ্দ থাকতে হবে। শিল্পোৎপাদনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সারের ওপর ভর্তুকি বৃদ্ধি করা, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে শুল্ক সুবিধা, কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রতি বছরই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট বাড়ানো হয়। আসন্ন বাজেটেও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে নতুন উপকারভোগী অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভাতার হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা যেতে পারে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে আমদানি ব্যয় রফতানি আয়ের তুলনায় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে আমদানি ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ এবং রফতানির পরিমাণ আমদানির তুলনায় কম হওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এতে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তাই এবারের বাজেটে বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণে কৌশলী হতে হবে। যেসব ব্যবহার্য দ্রব্য এমনকি উৎপাদনের উপকরণ দেশে পাওয়া যায় সেসবের ওপর যৌক্তিক শুল্ক বৃদ্ধি করে আমদানি নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরি। গত কয়েক বছরে সর্বোচ্চ গড় বিনিয়োগ ছিল ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ হার হলো ২৩-২৪ শতাংশ। আগামী বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। চলতি এডিপির পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। তবে আকার যা-ই হোক এডিপি বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। প্রতি বছরই বাস্তবায়ন আশানুরূপ না হওয়ায় অর্থবছরের শেষ দিকে বাজেট সংশোধন করে অর্থাৎ আকার কমিয়ে বাস্তবায়ন বেশি দেখানো হয়। সরকারি বিনিয়োগের গুণগত বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য সহায়ক শুল্ক কর কাঠামো প্রণয়ন করা জরুরি।

দেশের কর-জিডিপির অনুপাত কোনোভাবেই ৯-১০ শতাংশের ঊর্ধ্বে ওঠানো যাচ্ছে না। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ হার সর্বনিম্ন। দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর সঙ্গে আয়বৈষম্যও বাড়ছে। শ্রমবাজারের ৮৯ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। বেতন বা মজুরির পরিমাণও প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির সহায়ক নয়। সেজন্য কর আহরণে সরকারি প্রকল্প ব্যয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কোম্পানি করের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। কর সংগ্রহের নিম্নহারের জন্য প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও দুর্নীতি যেমন দায়ী, তেমনি উচ্চবিত্ত ও ব্যবসায়ীদের কর প্রদানে অনীহা ও ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও সমানভাবে দায়ী। এ যোগসাজশ চলতে থাকে বছরের পর বছর। সরকারি চাকুরে বা পেশাজীবীদের মধ্যে বেশি বেতনভোগী বিশেষ একটি শ্রেণি আইনের মারপ্যাঁচে কর প্রদানে বিরত থাকছে। আবার বেসরকারি খাতের অনেক চাকরিজীবী এবং দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করা যাচ্ছে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এ অসততা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এবারের ফিসক্যাল বাজেটে প্রত্যক্ষ করের কোনো হার কমানো উচিত হবে না, বরং উচ্চবিত্তদের কাছ থেকে প্রগ্রেসিভ হারে অধিক কর আহরণে মনোযোগী হতে হবে। বিগত কয়েক বছরে করপোরেট কর হার ৭ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর আদায়ে কী প্রভাব পড়েছে তা জরিপ করে দেখা প্রয়োজন। এর প্রভাবে যদি সার্বিক কর জিডিপি হারে উন্নতি না হয় তবে করহার হ্রাসের দিকে না যাওয়াই ভালো। কর প্রদানে সক্ষম লোকজনকে করের আওতায় আনার জন্য কর জরিপ ও কর আহরণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালুর বিকল্প নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানার হিসাবে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য উৎপাদন, কাঁচামাল ব্যবহার ও বিক্রয়ে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার সিস্টেম ও কার্যকর অডিট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এবারের বাজেট বাস্তবায়নের বছরেই এনবিআরের প্রশাসনিক সংস্কার ও আধুনিকায়নে জোর দিতে হবে। 

বাজেট ঘাটতি কোনোভাবেই যাতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অতিক্রম না করে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করে সরকারি ঋণগ্রহণ কমিয়ে আনতে হবে। এ পর্যন্ত যে ঋণ করা হয়েছে তার সুদ পরিশোধের পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলছে। আগামী বছর কেবল সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের তুলনায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি। ঋণগ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যদি এর রিটার্ন বা কস্ট-বেনিফিট অনুপাত ধনাত্মক না হয় তবে সে প্রকল্প সম্পদ না হয়ে দায় হিসেবে পরিগণিত হয়। শ্রীলংকার উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

বৈশ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি, মন্দার হাতছানি, অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতির কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকলেও বিপদের আশঙ্কা নেই বলে প্রতীয়মান। রেমিট্যান্সের প্রবাহ সাম্প্রতিক সময়ে কমলেও অচিরেই বাড়বে বলে আশা করা যায়। কারণ এ বছর বিদেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও ধরে রাখতে হবে এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। ব্যাপক হারে রফতানি বহুমুখীকরণে এগিয়ে আসতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের ন্যায় সব সম্ভাবনাময় রফতানি খাতকে সমান সুবিধা প্রদানের নীতি গ্রহণ এবং রফতানি আয় সম্পূর্ণ দেশে আনয়নের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রভৃতি সবাই সমন্বয়ের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে কোনো মহল বিশেষ আর্থিক ও ব্যাংক খাতে অহেতুক ভয় সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিকে অস্বস্তির দিকে নিয়ে না যেতে পারে। মানুষের কর্মসংস্থান, ভোগচাহিদা, দেশের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে বাংলাদেশের অগ্রসরমাণ অর্থনীতিতে বিপর্যয় হবে না। তবে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সতর্কতা ও কার্যকর পদক্ষেপের বিকল্প নেই।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত