আবদুল গাফফার চৌধুরীর যে জীবনের মরণ নেই

সম্পাদকীয়
এম এ হানিফ,
০৬:০১:০৭পিএম, ২৮ মে, ২০২২
এম এ হানিফ, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জনতার ইশতেহার।

যুগ যুগ ধরে অমরত্ব খুঁজতে গিয়ে মানুষ সব চেয়ে বড় যে বিষয়টি এখন পর্যন্ত পেয়েছে, সেটি হচ্ছে মানুষ তার সৃষ্টি ও কর্মের মধ্য দিয়ে অমর হতে পারে। মৃত্যুর পর ধন-সম্পদসহ ব্যবহৃত অব্যবহৃত সব নিজের নামের পাশ থেকে দূরে সরে যাবে। স্ত্রী-সন্তান কিংবা উত্তর-প্রজন্ম এ সবের মালিক হবে। মালিকানার পাশে লেখা হবে নতুন নাম। সেই সম্পদ কার ক্ষতি করবে, কার উপকারে আসবে এর কিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকবে না দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া ব্যক্তির। অর্থাৎ সব ধরনের অমরত্বের আশা-ভরসার সমাপ্তি।

এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু নিজের কর্ম ও সৃষ্টি। এটি যুগ যুগ ধরে ব্যক্তিকে অমর করে রাখে। এমনই একটি নাম- মহান একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’— রচয়িতা, বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। এমন অর্থপূর্ণ জীবন তিনি যাপন করে গেছেন, এর কোনো বিকল্প নেই। মহাকালের আবর্তে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তির মসনদও নিরাপদ নয়। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে নিরাপদ আবদুল গাফফার চৌধুরীর আসন। তার কর্ম এমনই উচ্চতর জায়গায় পৌঁছেছে। তা আর টেনে নামানো সম্ভব নয়। বরং কালে কালে উজ্জ্বল হবে। তার রচিত একুশের গান সকল বাঙালির মনে বাজবে সরবে-নীরবে কালে কালে। তাই আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবনাবসানের ক্ষতি কখনোই পূরণীয় নয়। তিনি বাঙালির জাগরিত চৈতন্যে স্বপ্নের বার্তাবাহী এক তাৎপর্য হিসেবে থেকে যাবেন। কারণ স্বপ্নের মরণ নেই। 

আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিদায় মেনে নিতে প্রস্তুন নই আমরা। আমরা অপেক্ষা করবো জাতীয় দুর্দিনে দুর্বিপাকে সংকট ও সম্ভাবনায় কলম ধরবেন তিনি। তার একটি লেখার জন্য আমরা পত্রিকার পাতায় পাতায় চক্কর দেবো। আমরা একুশের প্রভাত ফেরিতে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত অমর গানটির জন্য কানপেতে থাকবো। তার সত্যনিষ্ঠ বক্তব্যের জন্য খবরের কাগজগুলো হাতড়াবো। এভাবে তিনি আমাদের মধ্যে থাকবেন। এখন এর  জন্যই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। 

‘ভস্মাবশেষ পার হয়ে যেই শ্যামল ক্ষেতে নেমেছিলাম

নষ্ট তারার নগ্ন আলোয় যে বীজ আমি পুঁতেছিলাম

শস্য হয়ে জন্ম নিলো সবুজ পাতায় সে স্বৈরিণী

ভালোবাসার পণ্য লয়ে করলো কেবল বিকিকিনি।’ (আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতার অংশবিশেষ)।

ই নির্মেদ উচ্চারণ আমাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রজীবন সর্বত্রই মিলে যায়। 

আবদুল গাফফার চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ফলে পরাধীন বৃটিশ যুগ থেকে বর্তমান বাংলাদেশ তার দেখার পরিধিতে রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচার, বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট, জাতিগত নিপীড়ন, ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি ও তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর সক্রিয় চোখে দেখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ফলে তার কবিতাটিতে এসবের একটি মর্মরূপ ভেসে ওঠে। তিনি দেশে-প্রবাসে যেখানেই থাকুন বাংলাদেশ ছিলো তার আত্মা। আর সেই আত্মার পরিচর্যা তিনি সব সময় করতেন। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামে সংকটে তিনি মুখ বুঝে থাকেননি, থাকতে পারেননি।  

বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জনটি হচ্ছে- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রতিবেশি ভারত ও পাকিস্তানও বৃটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়। কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফারাক আসমুদ্র। ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিই এই পার্থক্য গড়ে দেয়। ঐতিহাসিকভাবে নানা চড়াই-উতড়াই পার হয়ে এই জনপদের মানুষ একটু স্বাধীন ভূমি চেয়েছে। যে ভূমিতে থাকলে তারা অবাধে শস্য ফলাতে পারবে আর নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু এর জন্য রক্তগঙ্গা বইয়ে গেছে- এই রক্ত ঢেলে দিয়েছে বাঙলার মানুষ। এরপরও এই দেশের মানুষ শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়েছে, এমনটিই মনে করতে আবদুল গাফফার চৌধুরী। যে কারণে তিনি সক্রিয় থেকেছেন শেষ পর্যন্ত। তৃপ্ত হয়ে কিংবা ভয়ে ভড়কে যাননি। এটিই ছিলো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর তার সৃষ্টি ও কর্মে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা। 

আবদুল গাফফার চৌধুরী এক কর্মমুখর জীবনের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিভিন্নভাবে নিজের পেশা ও কর্মাবলীকে বিন্যাস করেছেন। তার মধ্যে সাংবাদিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নানা সময় তিনি নানা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, কাজ করেছেন। এর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান আবদুল গাফফার চৌধুরী। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র 'সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় 'দৈনিক আনন্দবাজার' ও 'যুগান্তর' পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর 'দৈনিক জনপদ' বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। 

এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি 'বাংলার ডাক' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। 'সাপ্তাহিক জাগরণ' পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে 'নতুন দিন' পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে 'নতুন দেশ' এবং ১৯৯১ সালে 'পূর্বদেশ' বের করেন। প্রবাসে বসে গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়।

বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগ পন্থী কলামিস্ট হিসাবে পরিচিত এবং সমালোচিত ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসাবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলী ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তিনি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরব ছিলেন। এ জায়গায় কখনো আপোস করেননি। এই কারণেই তাকে হারানোটা গোটা জাতির ক্ষতি। নিশ্চয়ই নতুন প্রজন্ম তার কর্মময় জীবন ও সৃষ্টি থেকে অনুপ্রাণিত হবে। যার ধারাবিহকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। এটিই হতে পারে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে হারানোর কালে আমাদের বড় প্রত্যয়।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জনতার ইশতেহার