৬ষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম শুরু " শুমারিকর্মীকে নির্ভুল তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন

সম্পাদকীয়
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
০৫:০৪:১৯পিএম, ১৪ জুন, ২০২২

স্বাধীনতার একান্ন বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় আড়াই গুণ হয়েছে। তবে বৃদ্ধির হার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এমন বাস্তবতায় জনসংখ্যার হালনাগাদ পরিসংখ্যান জানতে বুধবার  (১৫ জুন) থেকে ৬ষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে জনশুমারি ২০২২। 

এবারই প্রথম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ব্যবহার করা হবে ডিজিটাল পদ্ধতি। এই সময়কে ‘শুমারি সপ্তাহ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। শুমারি শুরুর আগে মঙ্গলবার  (১৪ জুন) রাত ১২টাকে ‘শুমারি রেফারেন্স পয়েন্ট বা সময়’ হিসেবে ধরা হয়েছে। জনশুমারি উপলক্ষ্যে স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করলেন রাষ্ট্রপতি ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ উপলক্ষ্যে উদ্বোধনী খাম ও স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। পরবর্তিতে ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি অনুযায়ী ৭ কোটি ৪৬ লাখ মানুষের তথ্য দেয় সরকার।

দ্বিতীয় আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয় ১৯৮১ সালে। ১০ বছর পর্যাবৃত্তি অনুসরণ করে দেশের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয় ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালে। 

সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭৭২ হাজার ৩৬৪ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। তখন জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৪ লাখ।

২০২১ সালে শুমারি হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারিতে আটকে যায়। এক বছর দেরিতে যা শুরু হচ্ছে ১৫ জুন। ষষ্ঠ শুমারি চলবে ২১ জনু পর্যন্ত। ইতিমধ্যে শুমারির নামেও এসেছে পরিবর্তন। ‘আদমশুমারি’ শব্দের জায়গায় বসেছে ‘জনশুমারি’।

এবারই প্রথম তথ্য সংগ্রহে ব্যবহার করা হয়েছে ডিজিটাল ডিভাইস। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, “জনশুমারির তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমে শুমারি কর্মী হিসেবে সারাদেশে প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার গণনাকারী, ৬৪ হাজার সুপারভাইজার ও বিবিএসের সাড়ে চার হাজারের অধিক কর্মচারী এ প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবেন। এছাড়াও বিবিএস বহির্ভূত বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রায় ৯০০ জন কর্মচারী জোনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন।জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৭৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

 পেপার বেইজ প্রশ্ন নিয়ে গেলে যতক্ষণ সময় লাগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে গেলে বেশি প্রশ্ন নিয়ে গেলেও তার থেকে কম সময়ে করতে পারবো।”

প্রবাসী বাংলাদেশিদের তথ্য নেয়ার পাশাপাশি দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। 

দিলদার হোসেন আরও বলেন, “স্যানিটেশন ফ্যাসিলিটিজ কি আছে, ড্রিঙ্কিং ফ্যাসিলিটিজ কি আছে, সেখানে কারা বসবাস করছেন, সেখানে কোন বিদেশি বসবাস করছেন কিনা- এরকম সামগ্রিক তথ্য উঠে আসবে।”

এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৮ লাখ।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন..১৫৮২ সালে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে প্রথম জরিপ ও ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৭৯০ সালে এবং পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ১৮০১ সালে আদমশুমারি পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ে আদমশুমারি একটি জনগোষ্ঠীর বা দেশের জনসংখ্যা গণনার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ। তথ্য একত্রীকরণ এবং জনমিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যাদি প্রকাশ করা বোঝায়। আদমশুমারিতে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ থাকা প্রয়োজন ১. প্রতিটি ব্যক্তির তথ্য গণনা, ২. একটি চিহ্নিত এলাকায় সামষ্টিক গণনা, ৩. একই সঙ্গে সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা এবং ৪. নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠান।

আদমশুমারির জন্য সুপারিশ করা প্রয়োজনীয় বিষয়াদির মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য: আদমশুমারির সময় যেখানে পাওয়া গেছে অথবা যেখানে বাস করেন, জন্মস্থান, বর্তমান বাসস্থানে কতদিন যাবত বাস করছেন, পূর্বের বাসস্থান, কর্মস্থান; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত এবং বাড়ি সংক্রান্ত তথ্যাদি: লিঙ্গ, বয়স, বাড়ির প্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিবার প্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক, বৈবাহিক অবস্থা, বিবাহের মেয়াদকাল, বিবাহক্রম, মোট জীবিত জন্মগ্রহণকারী সন্তান সংখ্যা, বর্তমানে জীবিত সন্তানসংখ্যা, নাগরিকত্ব, শিক্ষা, স্কুলের উপস্থিতি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাগত অর্জন, জাতীয়/নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা, ধর্ম এবং তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য কর্মের ধরন, পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন ধারণের প্রধান উৎস্য।

এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আরো কিছু তথ্য আদমশুমারির জন্য প্রয়োজনীয়। ১. ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ: জনসংখ্যার সমষ্টি, এলাকা-শহর, গ্রাম, ২. ব্যক্তিগত এবং বাড়িসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য: পরিবারের গঠন, বাড়িতে বসবাসকারী সদস্যদের গঠন, ৩. অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য: আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নির্ভরতা ইত্যাদি। আইনত অথবা কার্যত পদ্ধতিতে আদমশুমারির প্রতিটি মানুষকে আবাসিক অথবা কোনো একটি এলাকায় উপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রাচ্য অথবা প্রতিচ্যের মধ্যযুগীয় সরকারসমূহ কর অথবা সামরিক বাহিনীতে জনসাধারণের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনে কখনো কখনো আদমশুমারির আশ্রয় নিতেন। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম উইলিয়ম ১০৮৬ সালে ডুমস ডে বুক অথবা ডোমসডে বুক নামে জমি অথবা জমিতে বসবাসকারী মানুষের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এটি ইতিহাসের সর্বপ্রথম নথিভুক্ত আমদশুমারি হিসেবে পরিচিত।

একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হয়। সেই পাকিস্তানের প্রথম আদম শুমারি ১৯৫১ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫৬ লাখ ৭২ হাজার ৪৬৯ জন। তারমধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪২ জন। নারী ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৪ জন। সেখানে পূর্বপাকিস্তানে ৪ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৩২৯ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ জন।

আর ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় আদম শুমারিতে দুটি প্রদেশে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ২০ হাজা ৬১৩ জন। নন পাকিস্তানি ছিল ১১ হাজার ৩৬৯জন সহ মোট জনসংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৮২ জন। এই ১০ বছরে বৃদ্ধিার হার ২৩.৯ শতাংশ। তার মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৮ হাজার ৬৪৫ জন ও নন পাকিস্তানি ১৩৪৮৬ জনসহ মোট ৫ কোটি ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৭২১ জন ও নারী ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১১ হাজার ৯৬৮ জন সেখানে নন পাকিস্তানি ৯৭৮৮৩সহ মোট জনসংখ্যা দাঁড়য়ি ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৮ হাজার ২৬১ জন। সেখানে পূর্বপাকিস্তানে পুরুষ ৫ কোটি ৮ লাখ ৪০ হাজার ২৩৫ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৭৮ জন।

বিশ্বের জনসংখ্যার দিকে তাকালে দেখা যায়, এ সময় চীনের জনসংখ্যা ৬৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার ও হার ছিল ২.৮। ভারতে ৪৩ কোটি ৪৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯৩৯ ও হার ছিল ২.২। পাকিস্তানে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৮২ জন ও হার ছিল ২.২। ব্রাজিলে ৭ কোটি ৯ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৫ জন ও হার ছিল ৩.৬। অর্থাৎ ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাজ্যে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫৬ জন ও হার ০.৭।

পরিশেষে বলতে চাই  সঠিক পরিসংখ্যান না থাকার কারণে উন্নয়নধারায় কখনো কখনো কোনো কোনো জনগোষ্ঠী, অঞ্চল, পেশাজীবী, নৃ-গোষ্ঠী বাদ পড়তে পারে। তার অনেক উদাহরণও আছে। তাই উন্নয়ন পরিকল্পনায় সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়াটা জরুরি। এই কাজের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদেরকে আমরা সবাই সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করবো। এমনকি কোনো কারণে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও যদি ভুল করেন, তাহলে তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে নিজ উদ্যোগে। যদিও যারা একবার বাদ পড়বেন, পুনরায় তাদের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

আমরা মনে করি, সবাইকে জনশুমারিতে নির্ভুল তথ্য দিতে হবে। প্রয়োজনে নিজের উদ্যোগেই তা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কেননা এ জনশুমারিতেই ফুটে উঠবে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র।যথযথ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নির্ভূল পরিসংখ্যান। এবারই প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজ শুরু হচ্ছে।, এবার হবে অতীতের তুলনায় সবচেয়ে নির্ভুল গণনা। লেখক, প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।