‘বাড়ি চলো’- রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার আকুতিঃ টনক নড়বে কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের?

সম্পাদকীয়
ডোরিন চৌধুরী
০১:৫৬:৪২পিএম, ২১ জুন, ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ গতকাল পালন করলো শরণার্থী দিবস। দেশে-বিদেশে এবছর ‘নিরাপত্তা খোঁজার অধিকার সবার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালন করা হয়েছে দিনটি। ঠিক একই সময়ে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে চলছে ‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা সমাবেশ। বেশ কয়েকদিন ধরেই আরাকানে পূর্বপুরুষের বাসস্থানে ফিরে যেতে রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীরা ছোট ছোট সমাবেশ, মিছিল, ও প্রচার-প্রচারণার মধ্য দিয়ে বাড়ির ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ ও জনমত গঠনে কার্যক্রম চালাচ্ছিল।

এরই ধারাবাহিকতায় গত, ১৯শে জুন কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে একই সাথে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো যেখানে অংশ নিলো লাখো রোহিঙ্গা। গণহত্যার শিকার জনগোষ্ঠীটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যপক সরব তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতের দাবীতে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের সময়, রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার এই আকাঙ্ক্ষা জ্ঞাপন কি ইঙ্গিত দিচ্ছে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়ার সময় কি তবে এলো? প্রশ্নের উত্তর খুজতে নজর দিতে হবে ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা ও এর তাতপর্যের দিকে।

‘বাড়ি চলো’ ক্যাম্পেইন বা প্রচারণা চালাচ্ছে মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের নেতৃবৃন্দ। তবে প্রথম এই ‘আন্দোলন’ গড়ে তোলেন প্রয়াত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ মাস্টার। মুহিবুল্লাহ নির্মমভাবে খুন হওয়ার ছয়মাস আগে থেকে শুরু করেন এটি। তার মৃত্যুর পর তা চালিয়ে নিচ্ছেন তারই সহকর্মীরা। তাদের এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে তরুণ-যুবা এবং সর্বস্তরের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

ইংরেজি, বার্মিজ এবং রোহিঙ্গা তিনটি ভাষায় তারা ব্যানার-প্ল্যাকার্ড ব্যবহার করছে। তাদের বক্তব্য, “আমরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) রোহিঙ্গা জাতি। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছি। সে থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। ফেরত নিয়ে যাওয়ার আইনি সরকারও নেই মিয়ানমারে। সুতরাং আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। চলো বাড়ি ফিরে যাই।” তাদের বক্তব্যে স্প্রষ্ট যে, দীর্ঘ পাঁচ বছর বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকতে থাকতে তাদের ধৈর্য্যের পারদ সীমা অতিক্রম কড়ছে দ্রুতই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা তাদের হতাশ করেছে এবং তারা আর সে আশায় থাকতে চাচ্ছে না। তাই স্ব-উদ্যোগেই বাড়ি ফিরতে চায় জনগোষ্ঠীটি।

সমাবেশ, বিক্ষোভ ও প্রচারণার পাশাপাশি এই ক্যাম্পেইনের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গারা বিশ্ববাসীর কাছে ১৭ দফা দাবিও তুলে ধরেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোহিঙ্গা স্বীকৃতি প্রদান, অবিলম্বে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা, ১৯৮২ এর নাগরিকত্ব আইন বাতিল, আরটুপি এর অধীনে আরাকানে আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থানকাল কমানো, এবং প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাস্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ সহ উল্লেখযোগ্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা পালন।

রাজনৈতিকভাবে, ক্যাম্পেইনটি রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব শুন্যতা দেখা দিয়েছিল যা হয়ত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অপশক্তিকে বেশ প্রশান্তি দিচ্ছিলো। কিন্তু এমন একটি ক্যাম্পেইন চালানোর পর জনগোষ্ঠীটির জন্য সুযোগ রয়েছে নতুন ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনার এবং শুন্যতা পূরণ করার। নতুন নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে অবিচল থাকা এবং নাড়ির টানকে ধরে রাখা। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়গ্রহণ সাময়িক, এটি যেন চিরবন্দোবস্ত হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে সচেষ্ট থাকা। নেতৃত্বের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হবে জাতির ইতিহাস, চেতনা ও স্মৃতিকে আগলে রাখা, নতুবা স্বকীয়তা হারানোর ভয় থেকেই যাবে।

শরণার্থী শিবিরের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়ও ক্যাম্পেইনটির জন্য সামনে বেশ বড় সুযোগ রয়েছে ঐক্য প্রতিষ্ঠার। গেলো কয়েকবছর ধরেই শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উত্তোরোত্তর অবনতি ঘটছে। সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা আর সহিংসতা বেড়েই চলছিলো। হতাশ ও সুবিধাবঞ্চিত রোহিঙ্গাদের দুর্বলতার সুযোগে বাড়ছিলো এসব অসামাজিক কর্মকান্ড। রাজনৈতিকভাবে তরুণ প্রজন্মকে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা এবং শিবিরে প্রত্যাবর্তনমুখী ঐক্য তৈরি করা গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন খুবই সম্ভব। প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

ব্যানার প্ল্যাকার্ডে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষার ব্যবহার, এবং রোহিঙ্গাদের ১৭ দফা দাবি থেকে বোঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি বরং তাদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ। তাদের স্ব-উদ্যোগের ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতায় তাদের হতাশার বহিপ্রকাশ মাত্র। তাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে রোহিঙ্গাদের এই মরিয়া অবস্থাকে আমলে নেয়া।

গেলো পাঁচ বছরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে জান্তাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার বিচার করতে। এছাড়াও তাদের উদ্যোগের অভাবে সমস্যা কেবলই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এতে, প্রায়ই মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিশ্ববাসী যেন ভুলতেই বসেছে। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ হতে পারে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রদত্ত তহবিলের পরিমাণ কমে যাওয়া। দু’তিন বছর ধরেই তহবিল কমে যাচ্ছিলো যার প্রভাব পড়েছে ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গাদের সহায়তাতেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে এখনো সময় আছে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অনুধাবন করার এবং দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার।

‘বাড়ি চলো’ রোহিঙ্গাদের ক্রমবর্ধমান হতাশার বহিঃপ্রকাশ এবং আমাদের ব্যর্থতার ফলাফল। এটি রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সচেতনতার উদাহরণ এবং কালেকটিভ মেমরির ও চিহ্ন বটে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গেলো পাঁচ বছরে নিরাপত্তার দৃষ্টি দেখার একটি প্রবণতাও তৈরি হয়েছে যেখানে শরণার্থীদের বেশ নেতিবাচকভাবেই বোঝার চেষ্টা করা হয়। এর পিছনে শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সমস্যার ফলে তৈরি হওয়া নিরাপত্তার বিষয়গুলোই মূলত দায়ী। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, ‘বাড়ি চলো’ একটি গণহত্যার শিকার জাতির নাড়ির টান যাদের গত পাঁচ বছরেও বাড়ি ফেরা হলো না। তাই, এটি একটি নিপীড়িত জাতির অধিকারের প্রশ্ন।

তাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে ক্যাম্পেইনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। মিয়ানমারের গত পাঁচ বছরের কূটনীতির নমুনা বলে তারা আসলে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী নয় বরং তাদের লক্ষ্য সমস্যা দীর্ঘায়িত করা যাতে বিশ্ববাসী একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় বা ভুলে যায়। এর বাইরেও, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার কুশীলব জান্তাপ্রধানদের ছাড় দেয়া একদমই ঠিক হবে না।

তারা ছাড় পেলে এটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইতিহাসে যা ভবিষ্যৎ অপরাধীদের উদ্বুদ্ধ করবে। তাই, এই ক্যাম্পেইনের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাসীর টনক নড়া উচিত। সর্বশেষে, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আকুতি মিয়ানমারে পৌছাক সেই কামনা করি, যেখানে আজ আপামর জনতা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে দখলদার জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ডোরিন চৌধুরী, নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডক্টোরাল গবেষক।