কূটনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ সক্ষমতায় বাংলাদেশ

সম্পাদকীয়
ড. দেলোয়ার হোসেন
১১:২৩:৩০এএম, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
ড. দেলোয়ার হোসেন । ছবি : দৈনিক জনতার ইশতেহার

আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে স্বাধীনতা বজায় রাখা যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমান বিশ্বে আমরা যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে পাচ্ছি, যে বৈরিতা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ সেগুলোকে মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ, আজকে আমরা যে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করছি, তাকে সাফল্যের মহাকাব্যই বলতে হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, বিশেষ করে বিগত প্রায় দেড় যুগকাল এক নতুন অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই জনপদ। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অভ্যন্তরীণভাবে অত্যন্ত দৃঢ় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে বাংলা ভূখণ্ড। বৈশ্বিক পর্যায়ে অভূতপূর্ব সাফল্যের জয়জয়কার।

সত্তর বা আশির দশকে বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবেএকটি দুর্বল দেশহিসেবে চিহ্নিত করা হতো, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের উপনিবেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো কিংবা একধরনের ভৌগোলিক নির্মমতার স্বীকার হতে হতো, তা আমরা উলটে দিতে পেরেছি। আজকের দিনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে, তা কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজন্ম নতুন ইতিহাস রচনা করবে আগামীর বিশ্বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে যে স্বকীয় অবস্থান মর্যাদা অর্জন করেছে, সে অর্জনকে কিছু রাষ্ট্র মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এমনকি বাংলাদেশের একশ্রেণির জনগণের মধ্যেও এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায়কী অদ্ভুত কথা! এটাসংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলননিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশ একটি ক্ষদ্র দুর্বল রাষ্ট্র ধরনের তকমাকে আমরা চিরতরে সমাহিত করতে পেরেছি স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র অর্ধশত বছরেই। গর্ব করার মতো অর্জন বইকি। এই যে নতুন পরিচয়ের বাংলাদেশ, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বড় ধরনের সম্ভাবনাময় জায়গা তৈরি হয়েছে, জাতি হিসেবে তা আমাদের পরম পাওয়া। স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ বাস্তবায়ন করছেন তিনি, তা জাতির সামনে খুলে দিয়েছে অসামান্য উন্নয়ন সমৃদ্ধির দুয়ার। একসময়ডিজিটাল বাংলাদেশনির্মাণের স্বপ্ন ছিল, তা আজ পূরণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অভিধানে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত। অর্জিত হয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও (এসডিজি) এই যে বহুমুখী অর্জন, সেখান থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে জায়গা করে নেবে বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ বছর হলো ২০৪১ সাল।রূপকল্প-২০৪১অমিয় সম্ভাবনাময় বাস্তব লক্ষ্য হিসেবে হাতছানি দিয়ে ডাকছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বপ্নের লাল-সবুজের বাংলাকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা বুনছি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেস্মার্ট বাংলাদেশগড়ার স্বপ্ন। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ তথা স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি স্মার্ট গভর্নমেন্টএগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি জীবনযাপনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। এসব কিছু একদিকে যেমন বিশ্বায়নের পরিবর্তন, অন্যদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে বাস্তবতা, তার নিরিখে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই স্বপ্ন দেখার ভিত্তি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের অর্জনের ওপর দাঁড়িয়েই।

আজ দেশের যে কূটনৈতিক অর্জন, তার পেছনে রয়েছে দূরদর্শী কূটনৈতিক কৌশল।সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, অর্থাৎ একটি জোট নিরপেক্ষ অবস্থান ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রেখে চলা। সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়েই মূলত টনৈতিক ক্ষেত্রেভারসাম্যপূর্ণ সক্ষমতাঅর্জন করেছে বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

আমরা দেখতে পাই, বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ চলছে। বেশকিছু হটস্পষ্ট বা অস্থিতিশীলতার উদ্ভব ঘটেছে। এই অবস্থায় বিশ্বে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যে ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে, যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, তার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ তার জোট নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

লক্ষ করলে দেখা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অবকাঠামোগত কিংবা সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ থাকে, তা অতিক্রম করে একটি সফল কূটনীতি অর্থনীতি পরিচালনার যে সক্ষমতা দরকার, বিশেষ করে গত এক-দেড় দশকে বাংলাদেশ তা সাফল্যের সঙ্গে অর্জন করতে পেরেছে। সমপর্যায়ের অন্য কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এটা করে দেখানো সম্ভব হয়নি বলে প্রতীয়মান।

কিন্তু এর পরেও আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে যে স্বকীয় অবস্থান মর্যাদা অর্জন করেছে, সে অর্জনকে কিছু রাষ্ট্র মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এমনকি বাংলাদেশের একশ্রেণির জনগণের মধ্যেও এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায়কী অদ্ভুত কথা! এটাসংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলননিঃসন্দেহে। এর কারণে কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জর মুখে পড়তে হয় বটে। এই অবস্থায় আরো বেশি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করা দরকার। শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দের মতো বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। এতে করে দেশে যে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে, তা স্থায়িত্ব পাবে এবং তার মাধ্যমেই আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বারূপকল্প-২০৪১’-এর উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সক্ষম হব। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের মূল সুর এটাই।

অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেছে। গোটা উপমহাদেশকেই কানেকটিভিটির আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ তো বটেই, এই অঞ্চল এখন পুরো বিশ্বের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। দেশের জন্য এক নতুন সক্ষমতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বময়। কানেকটিভিকে এভাবে শক্তিশালী করার ফলে দেশের ভূ-রাজনৈতিক ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে যা অনেক বেশি জরুরি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতেমহান বিজয় দিবসে প্রত্যাশা এটাই।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)