‘সংগ্রামী বাংলা দুর্জয়, দুর্বিনীত’

সম্পাদকীয়
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
১১:৪৫:৪৭এএম, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক । ছবি : দৈনিক জনতার ইশতেহার

মানবজীবনের ঘটনাবলীর কত অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখতে পাই আমরা! কারাগারে বসে লেখা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালে শোকাবহ আগস্ট মাসের সাত তারিখে ঢাকায় স্থাপিত সাবজেলের অন্ধকার কক্ষে বসে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দি হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তার জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও আপোস করেন নাই। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নাই। তার জীবনে জনগণই ছিল অন্তঃপ্রাণ। মানুষের সুখ-দুঃখে তার মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন—এটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এ মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্রের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তার মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা।’

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে প্রখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর এক দীর্ঘ সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। সাক্ষাত্কারের এক পর্যায়ে ফ্রস্টের প্রশ্ন ছিল, (একাত্তরের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে) আপনার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে যখন আপনি বেরিয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন আর কোনো দিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?’ প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু  বলেছিলেন, ‘না, আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, আজ যদি আমি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্ততঃ লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মাথা তুলে তাকাতে পারবেনা। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।’

ডেভিড ফ্রস্টের অপর এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মরতে রাজি তাকে কেউ মারতে পারেনা। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন, সে পতা তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে  পারেন? না, তা কেউ পারেনা। এটাই আমার বিশ্বাস।’

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মূলমন্ত্র আর অবরুদ্ধ দেশবাসীর বীজমন্ত্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যখন বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে সম্মোহনী ও আবেগমথিত ৭ই মার্চের ভাষণ সম্প্রচারিত হতো, তখন আক্ষরিক অর্থেই প্রত্যেক বাঙালির দেহের রোম খাড়া হয়ে যেত এবং স্মরণে আসত বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক উক্তি ‘সংগ্রামী বাংলা দুর্জয়, দুর্বিনীত। কাহারও অন্যায় প্রভুত্ব মানিয়া নেওয়ার জন্য, কাহারও কলোনি হইয়া, বাজার হইয়া থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয় নাই।’

ফ্রস্টের আরেক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষের প্রতিই আমার প্রথম ভালবাসা। আমি জানি আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরণশীল। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।’ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ঘাতকদের সামনে একইভাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্ত, স্থির, নিরুদ্বেগ ও নির্ভীক। তিনি মাথা উঁচু রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

আমৃত্যু সর্বদা মাথা উঁচু রেখে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতিকে এ অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মাথা উঁচু রেখেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কারাগারে বসে লেখা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা এখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থত্রয় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অবশ্যপাঠ্য। বঙ্গবন্ধু রচিত এই তিনটি মুল্যবান গ্রন্থ থেকে আমরা ইতিহাসের বহু অজানা তথ্যের সন্ধান পাই। গ্রন্থ তিনটি লেখার পেছনে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণা আমাদের জাতীয় জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে সেজন্য আমরা তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

বাঙ্গালির অবিসংবাদিত নেতা, গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৩ জানুয়ারি রমনার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণসহ ছয় দফা ও এগারো দফা কর্মসূচির উপর বিশ্বস্ত থাকার শপথ গ্রহণ করেন। লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সেদিন অপরাহ্নে নেয়া শপথবাণী শেষ বাক্যটি ছিল ‘জনগণ অনুমোদিত আমাদের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসী যে কোনো মহল ও অশুভশক্তির বিরুদ্ধে আমরা প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতঃ আপোসহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকব।’

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মূলমন্ত্র আর অবরুদ্ধ দেশবাসীর বীজমন্ত্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যখন বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে সম্মোহনী ও আবেগমথিত ৭ই মার্চের ভাষণ সম্প্রচারিত হতো, তখন আক্ষরিক অর্থেই প্রত্যেক বাঙালির দেহের রোম খাড়া হয়ে যেত এবং স্মরণে আসত বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক উক্তি ‘সংগ্রামী বাংলা দুর্জয়, দুর্বিনীত। কাহারও অন্যায় প্রভুত্ব মানিয়া নেওয়ার জন্য, কাহারও কলোনি হইয়া, বাজার হইয়া থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয় নাই।’

পাকিস্তান সেনা শাষকদের নির্দেশে পাক হানাদার বাহিনী এদেশে যেভাবে বর্বরোচিত গণহত্যা, গণধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ ও পুরুষশূন্য করার ন্যায় মানবতার বিরুদ্ধে নানা অপরাধ সংঘটিত করে, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের গেরিলারা প্রাণপণ যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করে। এ বিজয়ের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু তার অনুসারী বীরদের এমনভাবেই দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুত করেছিলেন যা কবি সুকান্তের উচ্চারণে বলতে পারি, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়;/ জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

মাথা উঁচু রাখার রাজনৈতিক দর্শনের উত্তরাধিকার বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন— আমরা যেন সবসময় তা স্মরণে রাখি। জেল, জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় সব সহ্য করেও বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন নেতৃত্বের শিক্ষাই হচ্ছে আত্মত্যাগ অনুশীলনের শিক্ষা। এই শিক্ষাই হোক জীবনের ব্রত।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।