টাঙ্গাইলের সাধারণ গ্রন্থাগারে বই আছে পাঠক নেই

সাহিত্য
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
০৮:২০:৪০পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
পাঠক শূন্য গ্রন্থাগার। ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের সাধারণ গ্রন্থাগারে দিনদিন পাঠকের সংখ্যা কমে আসছে। এক সময় গ্রন্থাগারটিতে পাঠকদের স্থান সংকুলান হতো না। এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে পাঠকের দেখাই মিলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এখন অনলাইনেই সব তথ্য পাওয়া যায়। ডিজিটাল প্লাটফর্মে সময় কাটানোর কারণে গ্রন্থাগারেও কমেছে পাঠক। তবে পাঠক বাড়াতে জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

জানা যায়, টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারটি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। এটি টাঙ্গাইল নিরালা মোড়ে সাধারণ গ্রন্থাগার মার্কেটের তৃতীয়তলায় পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারটির আজীবন সদস্য ৮৬৯জন। আর সাধারণ সদস্য রয়েছে তিন হাজারের ওপরে। তবে সম্প্রতি সাধারণ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৫০ জন চাঁদা পরিশোধ করেছেন। আর এই গ্রন্থাগারটিতে বই রয়েছে ২২ হাজার ৩১২টির ওপরে। গত ১৫ দিনে এই গ্রন্থাগারটিতে মাত্র ১৬ জন পাঠক বই পড়তে এসেছেন। এছাড়া মাঝে মধ্যে চাকরির বই ও পত্রিকা পড়তে দুই-চার জন পাঠকের দেখা মিলে।

এদিকে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৬২টি গ্রন্থাগারেও পাঠক কমেছে। তবে জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে প্রতিদিন শতাধিক পাঠক আসছে।  এদের মধ্যে সৃজনশীল বইয়ের চেয়ে চাকরির বই ও পত্রিকা পড়ার পাঠকই বেশি।

সচেতন মহল মনে করেন, যেকোনও চিন্তাশীল মানুষ তার সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়ায় গ্রন্থের পাতায়। একটি গ্রন্থাগার মানুষকে তার জীবনের দিকনির্দেশনায় সাহায্য করে। ব্যক্তি মানুষের প্রতি এই সাহায্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সামাজিক মানোন্নয়নের রূপ পায়। গ্রন্থাগার হলো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল। এখানে মানুষের চিন্তা, দর্শন, গবেষণা, ইতিহাস একত্রে স্থান পায়। তাই প্রতিটি সমাজেই গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই গ্রন্থাগারের পাঠক বাড়াতে জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বই পড়া আর গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়া, এই দুইয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক। গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়লে মনের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি আসে। আর জ্ঞানও বাড়ে।

স্থানীয় বাতিঘর আদর্শ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে মানুষ অনলাইন ও মোবাইলফোনে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে বই পাঠের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এ যুগে মানুষ অনেক ব্যস্ত। পাঠাগারে গিয়ে তাদের বই পড়ার সময় খুবই কম।’ বই সহজলভ্য বা হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেলে, ধীরে ধীরা পাঠাভ্যাস তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।

টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান হুমায়ুন তালুকদার বলেন, ‘গ্রন্থাগারে পাঠক একেবারেই কমে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণেও কিছুটা প্রভাব পড়েছে। এছাড়া মানুষ এখন মোবাইলফোনে বেশি সময় কাটায়। এ জন্য পাঠক কমেছে। পাঠক বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের সদস্য সচিব মাহমুদ কামাল বলেন, ‘একটা সময় গ্রন্থাগারে পাঠক ছিল অনেক। কিন্তু বর্তমানে মোবাইলফোন, কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরের কারণে সৃজনশীল বই পড়ার সময় পায় না। এছাড়া মানুষ নানা প্রযুক্তিতে সময় দিচ্ছে। সব চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে ফেসবুকে। এজন্য গ্রন্থাগারে পাঠক কমেছে। দুই-চারজন গ্রন্থাগারে আসছে শুধু চাকরির বই ও পত্রিকা পড়তে। মানুষ এখন তথ্য প্রযুক্তিতে আটকে আছে। অনেকে মোবাইলফোনের মাধ্যমে বই পড়ছে। এজন্য গ্রন্থাগারে পাঠক সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় কারও বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে অনেকেই বই নিয়ে যেতো। কিন্তু এখন দাওয়াতে বই নিয়ে গেলে মানুষ মাইন্ড করে। মাইন্ড করলে বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকবে কিভাবে। আগে সবার বাড়িতেই বই পড়া ও হারমোনিয়ামের শব্দ পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেই শব্দ আর শোনা যায় না। এখন যারা একটু ছাত্র ভালো, তারা লেখাপড়া করে। আর যেটুকু সময় থাকে, সেটুকু সময় তারা ফেসবুকে দিচ্ছে। আমাদের কেউ বলেনি, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ো। আগে পরিবারের লোকজন ছেলে-মেয়েদের অ্যাকাডেমিক বই পড়তে বলতো। কিন্তু এখন উল্টো পরিবারের লোকজন পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে বলে, কিন্তু ছেলে-মেয়েরা বই পড়ে না। তারা সারাক্ষণ ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’

টাঙ্গাইলের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (বাংলা) তরুন ইউসুফ বলেন, ‘করোনার কারণেও কিছু প্রভাব পড়েছে। গ্রন্থাগারে আসা-যাওয়ার যে চর্চা ছিল, সেটা এখন নেই। এখন মোবাইলফোনে ইচ্ছে করলেই সব পাওয়া যায়। পছন্দের বই অনলাইনে পাওয়া সম্ভব। এ কারণে সরাসরি পাঠ করা কমেছে। যান্ত্রিকযুগে মানুষের হাতে সময় কম। মানুষ অনেকটা মোবাইলফোন ও কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, পাঠক বাড়ানোর জন্য প্রচারণা প্রয়োজন। পাঠাগারে পাঠক কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়ে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। এছাড়া পাঠকদের মধ্যে বই পড়ার প্রতিযোগিতা বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বাড়ানোরও প্রয়োজন। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বই দেয়। আবার কে কয়টা বই পড়েছে সেটার ওপরে কম্পিটিশনও হয়, পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে করে পাঠক উৎসাহিত হয়।